ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভারতের প্রতি চাপ বৃদ্ধির কৌশল: রাজনৈতিক মহলে জোর আলোচনা

ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভারতের প্রতি চাপ বৃদ্ধির কৌশল: রাজনৈতিক মহলে জোর আলোচনা

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ফের ভারতের প্রতি কঠোর অবস্থান নিয়েছেন, যা আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে আলোচনার সৃষ্টি করেছে। ট্রাম্প সম্প্রতি এক জনসভায় অভিযোগ করেন, ভারত বহু বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে “অন্যায্য” বাণিজ্য সুবিধা নিচ্ছে এবং এতে মার্কিন অর্থনীতি ক্ষতির মুখে পড়ছে। তাঁর ভাষায়, “আমরা ভারতের কাছ থেকে কিছুই পাই না, অথচ তারা আমাদের সব কিছু নেয়। এভাবে আর চলতে দেওয়া যাবে না।” ট্রাম্প আরও ইঙ্গিত দেন, যদি তিনি আবার ক্ষমতায় ফিরে আসেন, তাহলে ভারতের ওপর শুল্ক বৃদ্ধি, বাণিজ্য চুক্তির পুনর্বিবেচনা এবং প্রযুক্তি স্থানান্তরের মতো বিষয়গুলোতে কঠোর নীতি গ্রহণ করা হবে

বাণিজ্য ঘাটতির বাস্তবতা

ট্রাম্পের অভিযোগের পেছনে আংশিক সত্য থাকলেও, বিশ্লেষকরা বলছেন, তা পুরোপুরি সঠিক নয়। ২০২৪ সালের তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে বার্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ২০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাটতি প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলার। যুক্তরাষ্ট্র ভারতের জন্য বৃহত্তম রপ্তানির গন্তব্য, আবার ভারতও যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান বাণিজ্য অংশীদার। এই সম্পর্ক শুধু পণ্য বাণিজ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; তথ্যপ্রযুক্তি, প্রতিরক্ষা, শিক্ষা ও চিকিৎসা খাতেও গভীর সহযোগিতা রয়েছে।

ভারতের প্রতিক্রিয়া: সচেতন নীরবতা

ভারতের সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রাম্পের মন্তব্যে এখনো কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “ট্রাম্প এমন মন্তব্য এর আগেও করেছেন। ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক মজবুত রাখতে আগ্রহী, এবং তা নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা প্রশাসনের ওপরে নির্ভর করে না।”

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ভারতের এই সচেতন নীরবতা একটি কূটনৈতিক কৌশল, যাতে বর্তমান বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট না হয় এবং ভবিষ্যতের সম্ভাব্য রিপাবলিকান সরকার সঙ্গেও আলোচনার পথ খোলা থাকে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মত

যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক গবেষক ড. মাইকেল হিগিন্স বলেন, “ট্রাম্প ভারতকে একটি প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখেন না বরং একজন কৌশলগত শরিক, কিন্তু তার বাণিজ্য নীতিতে ‘লাভ-ক্ষতির হিসাব’ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি চান, যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে যতটা সম্ভব কঠোর ও একপাক্ষিক চুক্তি করা হোক।”

বাংলাদেশের বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ড. সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, “ট্রাম্পের বক্তব্য শুধু ভারতের জন্য নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়ার জন্যই উদ্বেগের। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক যতটা দৃঢ়, ততটাই এই অঞ্চলের শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ট্রাম্পের মতবাদ সেই ভারসাম্যকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে।”

ভারতের রাজনৈতিক অঙ্গনের প্রতিক্রিয়া

ভারতের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস এই ইস্যুতে সরকারকে সতর্ক হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। কংগ্রেসের মুখপাত্র রণদীপ সিং সুরজেওয়ালা বলেন, “আমরা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একটি দায়িত্বশীল অবস্থানে রয়েছি। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক আমাদের অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সরকারকে কূটনৈতিকভাবে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।”

অন্যদিকে, বিজেপি সরকারের একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বলেন, “ট্রাম্পের এই বক্তব্য নির্বাচনী প্রচারের অংশ। আমাদের সম্পর্ক আমেরিকার রাষ্ট্রীয় নীতির ওপর নির্ভর করে, ব্যক্তির ওপর নয়। ভারতের বাজার ও জনবল যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।”

সামনের দিনগুলো কী বলছে?

২০২৪ সালের মার্কিন নির্বাচনের পর ট্রাম্পের রাজনীতিতে সক্রিয় ফিরে আসা বিশ্ব রাজনীতিতে আবারও অনিশ্চয়তা তৈরি করছে। ভারত-মার্কিন সম্পর্ক যদিও বহুস্তরবিশিষ্ট এবং গভীর, তবে ট্রাম্পের মতো অনিশ্চিত নেতার দৃষ্টিভঙ্গি কূটনৈতিক অগ্রগতিকে ব্যাহত করতে পারে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারত এখন দ্বিপাক্ষিক কৌশলগত সম্পর্কের পাশাপাশি বহুপাক্ষিক জোট ও বাণিজ্য চুক্তির দিকেও গুরুত্ব দিচ্ছে, যাতে একক দেশের ওপর নির্ভরতা কমে।


এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি এখন রয়েছে ২০২৫ সালের মার্কিন রাজনীতির গতিপথের দিকে। ট্রাম্পের ভারতবিরোধী কণ্ঠস্বর ভবিষ্যতের ভূ-রাজনৈতিক চিত্রে কী প্রভাব ফেলবে, তা সময়ই বলবে।

CATEGORIES
TAGS
Share This